দীর্ঘ দিন ধরেই রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। বস্তুতঃ মুক্তিযুদ্ধের পরই এই সঙ্কট কম বেশি বিদ্যমান। সঙ্কট ক্রমেই তীব্র ও জটিল হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বুর্জোয়া রাজনীতির ব্যর্থতা। ধনিক শ্রেণীর বিশেষত লুটেরা ধনিক শ্রেণীই এই সঙ্কটের জন্য দায়ি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে ছিল মধ্যস্তরের জনগণ। শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষ ও ব্যাপক জনগণ এই যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মধ্যবিত্তের একাংশ নব্য ধনিকে পরিণত হয়। এদের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশি ঋণ সাহায্য লোপাট, চোরাচালান, কালোবাজারি, ফটকাবাজারী ইত্যাদির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়। শাসক শ্রেণির মধ্যে এই লুটেরা শ্রেণীরই প্রাধান্য বা নেতৃত্ব। এই লুটেরা শ্রেণী বেপরোয়া অস্থির। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা বা কোন সিস্টেম এদের ধাতে সয় না। ডাকাতদেরও মধ্যে একটা নিয়ম থাকে , লুটেরারা কোন নিয়ম শৃঙ্খলা মানে না। নিজেদের করা নিয়ম রীতি তারা লঙ্ঘন করে। তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’। নিয়ম যাই থাকুক না কেন, আমার টাকা চাই, ক্ষমতা চাই । আইন-বিধান-নিয়ম হবে ক্ষমতা বান্ধব নিজেদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়াড়। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য আইন বিধি যা করার করতে হবে। প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তবর্তীকালীন সরকার অথবা জাতীয় সরকার কিম্বা সেনা সমর্থিত সুশীল বা কুশীল সরকার যাই হোক একটা কিছু চাই। কয়েক যুগ ধরেই ধনিক শ্রেণি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কোনোভাবেই তারা দেশ চালাতে পারছে না। মূমুর্ষ ব্যাধিগ্রস্তর মতো একবার চিত হয়ে আরেকবার কাত হয়ে বা উপুড় হয়ে কোনোভাবেই তারা স্বস্তি পায় না। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি, বহুদলীয় ব্যবস্থা , একদলীয় ব্যবস্থা, সামরিক শাসন অথবা সেনাসমর্থিত সরকার এমনি হরেক রকম এক্সপেরিমেন্টের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবুও উপায় নেই গোলাম হোসেন! নিস্তার নেই এই সঙ্কট থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে আজকের যে ধনীক শ্রেণী। তার ললাটে লেখা আছে এমনি সঙ্কট এবং অস্থিরতা। এই সঙ্কট সমাধান করতে তারা অক্ষম ।রাজনীতির হাল যতদিন এই ধনীক শ্রেণীর হাতে থাকবে ততোদিন কম-বেশি এই সঙ্কটের আবর্তেই দেশ ঘুরপাক খেতে থাকবে ।এই সঙ্কটের পাপ চক্র থেকে মুক্তি দিতে পারে শ্রেণীগতভাবে একমাত্র শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষ । শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর,প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সমাজ, র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবী ছাড়াও, তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা । ধনীক শ্রেণীর মধ্যে উৎপাদনশীল ও উদ্দ্যোক্তাদের মধ্যে সমাজ অর্থনীতির বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে, যে ইতিবাচক প্রবনতা আছে তাতে তাদের কোন অংশ শক্র ,মিত্র বা নিরপেক্ষ থাকবে কি না তা নিয়ে অনেক তর্ক আছে। কিন্তু বামপন্থীরা প্রথমে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য সে নিয়ে কোন বিতর্ক নেই ।
বুর্জোয়া রাজনীতির এক রকম সঙ্কট আর বামপন্থীদের আরেক ধরনের সঙ্কট। বামপন্থীরা বহুধা বিভক্ত। এদের সবাইকে দল বলাটাও ভুল হবে। এদের অনেকেই ছোট ছোট গ্রুপ। সভ্য, সমর্থক, কাজ কর্মও খুব সামান্য। গণভিত্তির কোনো কথাই নেই । ওটা যে নেই, সে নিয়েও কোন আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না ।। অনেকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কথা বলেন বটে কিন্তু মতাদর্শে, রাজনীতিতে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, কাজেকর্মে, সাংগঠনিক কাঠামো এবং সামাজিক ভিত্তি ও রীতি-নীতিতে লেনিনীয় পার্টির ধারে কাছেও নেই। সোশ্যাল কম্পোজিশন এর ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণী বা মেহনতি মানুষের সমাবেশ নেই বললেই চলে। শ্রেণী সংগ্রামের বুলির আধিক্য থাকলেও বাস্তবে কোনো শ্রেণী সংগ্রামেই এদের পাওয়া যায় না। শ্রেণী সংগ্রামের ভাষণে এবং লেখনীতে বেশ পটু এরা। বাস্তবে এরা অনেকেই পেটি বুর্জোয়া র্যাডিক্যাল কেউ কেউ এনজিও মার্কা ও বিদেশী অর্থপুষ্ট । যাদেরকে বামপন্থী দল বলা যায় তাদের শক্তি ও গণভিত্তি যথেষ্ট নয়। বুর্জোয়া রাজনীতির ব্যর্থতার মুখে বাংলাদেশকে সঙ্কটের পাপচক্র থেকে মুক্ত করতে হলে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। শক্তি বৃদ্ধির জন্য বামপন্থীদের ঐক্য জরুরি। শ্রেণি সংগ্রামে, জাতীয় সংগ্রামে, রাজনৈতিক গণআন্দোলনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে হবে। বামপন্থীদের কাজ কর্ম, জমায়েত এবং শক্তি দিয়ে মানুষের মধ্যে এই আস্থা সৃষ্টি করতে হবে যে বামপন্থীরা ক্ষমতায় যেতে পারে।
বুর্জোয়া রাজনীতি আমাদের দেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বেশ সাফল্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাবদল করে ক্ষমতায় থাকছে। বাস্তবে এবং মানুষের ধারণার মধ্যেও এই দুই মহল। আর একটি শক্তি যে ক্ষমতায় আসতে পারে এমন কথা ভাবে না সাধারণ মানুষ। মানুষ কিন্তু বামপন্থীদের ভালো জানে। এরা দেশপ্রেমিক, দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে লড়াই সংগ্রাম করে, সৎ, নিঃস্বার্থ, কিন্তু এরা তো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সে শক্তি তাদের নেই।
বামপন্থীদের এই প্রশ্নটির মোকাবেলা করতে হবে। এক, তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। দুই, ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তাকে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।বামপন্থীদের প্রচলিত ভূমিকা দেখে মানুষ মনে করে বামপন্থীরা জাতীর বিবেক ।তারা তাদের আদর্শগত অবস্থান থেকে সব সময় সত্য কথা বলে ।কাজ কর্ম দেখে মনে হয় অনেক বামপন্থী সত্যের পক্ষে শুদ্ধ অবস্থানে থাকাতেই আত্মতৃপ্তি ভোগ করেন । জগৎকে ব্যাখ্যা করেই যেন শান্তি ।এই জগৎটা যে পাল্টাতে হবে, তা নিয়ে যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই ।। আওয়ামী লীগ বিএনপির কতটা সমালোচনা করলাম তার চেয়ে বড় কথা বামপান্থীরা কী করবে? তারা কি শুধু জাতির বিবেক হয়ে থাকবে?বামপন্থীরা কি রাজনীতির সাইড লাইনে থাকবে, শুধু সঠিক কথাটি বলে যাবে নাকি কিছু একটা করবে, ঘটাবে! বামপন্থীদের বক্তব্য নিয়ে, ক্ষমতার প্রশ্ন নিয়ে,ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতির পুরোভাগে আসতে হবে ।
বামপন্থী দলের মধ্যে তত্ত্ব নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক আছে। দলের ভেতরেও তর্কের ঝড় কম নয়, এসব বিতর্কের অবসান কীভাবে হবে? কাজের মধ্যদিয়ে, আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
বামপন্থীদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করেন। ঐক্য করার নানা চেষ্টাও হয়েছে বিভিন্ন সময়। গণতান্ত্রিক বামফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। এক সময় ভেঙ্গে গেছে। এক সময় পাঁচ দলীয় ঐক্য হয়েছে। এখন গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা গঠিত হয়েছে। মোর্চার মধ্যেও নানা ভিন্নতা ও তর্ক বিতর্ক আছে ।সেটাই স্বাভাবিক ।দুই একটি দল ইতমধ্যে বেরিয়ে গেছে বলে জানা যায় । মোর্চার ভেতরে একাধিক দল এক হয়ে এক পার্টিতে রূপান্তর হয়েছে।এ রকম দুটি আশা জাগানো ঘটনা ঘটেছে ।। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বামপন্থীদের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠেছে। আবার ভেঙ্গে গেছে। কমিউনিস্ট ঐক্য গড়ার চেষ্টা হয়েছে তা ব্যর্থ হয়েছে। বামফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা হয়েছে ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর এক পর্যায়ে ১২ দফা দাবি নিয়ে বামদের বৃহত্তর ঐক্য হয়েছিল কিন্তু নানা কারণে তা অগ্রসর হয়নি। এরপর সর্বশেষ বিভিন্ন ইস্যুতে মাঝে মাঝে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। একটি কর্মসূচি পালনের পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ ছিল সিপিবি আওয়ামী লীগের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করেছে।
বামপন্থীরা তেল-গ্যাস জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি আছে। তারা যুগপৎ দূরের কথা আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে আছে, মন্ত্রীও আছে। তারপর তো কোনো বামপন্থী তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি ছেড়ে আসেননি। একসাথে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। তাতে তো আন্দোলনের ক্ষতি হয়নি। কেউ ক্ষতি করতে চাইলে অন্যরা তখন তো আর বসে থাকবে না।
বামপন্থীদের মত ও পথের নানা পার্থক্য আছে। কেউ চায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, কেউ গণতান্ত্রিক বা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, কেউ বা জনগণতান্ত্রিক অথবা বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন। তাহলে কি ঐক্য হবে না? এক পার্টি করতে হলে এই প্রশ্নগুলি ফয়সালা করা প্রয়োজন বটে। কিন্তু কোনো ফ্রন্ট করতে হলেও কি এসব বিষয়ে একমত হতে হবে ? তাহলে ফ্রন্ট কেন? একটা পার্টি করে ফেললেই হয়। দেখা যাচ্ছে ১২ দফা বা এই জাতীয় দাবি নিয়েও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আপত্তি। তাহলে হোক না বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, আমাদের মত পার্থক্য আছে কিন্তু অনেক ইস্যুতে মিলও আছে। আমরা সবাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে।
আমরা তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর লুটপাটের বিরুদ্ধে। আমরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে, আমরা ধনীক শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে, শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের স্বপক্ষে। আমরা জনজীবনের সমস্যার সমাধান চাই,ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত সরকারের বাজারনীতি, স্বাস্থ্য নীতি, আবাসন নীতি, শিক্ষা নীতি, কৃষি নীতি, শিল্প নীতি, পরিবহন নীতি,পরিবেশ নীতি ইত্যাদর বিরুদ্ধে আমরা। এসব নিয়ে বিকল্প প্রস্তাবনাও আছে বামপন্থীদের। সে সবের মধ্যে মিল আছে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, এ নিয়ে কোনো টালবাহানা ঢিলেঢালার বিরুদ্ধে আমরা। আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপোষহীন। আমরা সবাই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি বাম বিকল্পই এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। তবে ওই সব দাবি নিয়ে কেন আমরা এক সাথে নামতে পারব না।
গত ৫ মে তারিখে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে আমরা বামপন্থীরা সভা-সমাবেশ মিছিল করলাম। একই দিনে একই সময়। একই দাবিতে। কিন্তু পাশাপাশি। কেন আমরা এক সাথে করতে পারলাম না? জমায়েত ছোট ছোট। সব মিলে কিন্তু বেশ বড় হতে পারত? এসব দেখে লোকে কী বলে? শত্রুরাই বা কী বলে। ছোটর মধ্যে আমরা কে একটু বড় জমায়েত করতে পেরেছি তাই নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। তত্ত্ব কথার ফুলঝুড়ি!
আশার কথা গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সাথে সিপিবি এবং সংশ্লিষ্ট দলগুলির মধ্যে আবারও ঐক্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আরও হবে বলে আশা করি।
সব ঠিকঠাক করে নামব আমরা? সময় যে ফুরিয়ে যাচ্ছে। বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্কট, তার দেউলীয়াপনা আর কতটুকু প্রকাশ পেলে আমরা বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নামার মতো করে নামব!
সময়ের দাবি আমাদের একসাথে পথে নামতে হবে ।সব ঠিক করে নামতে না পারলে নেমেই না হয় ঠিক করব ।হেমন্তের কন্ঠের একটি গান আমাদের জন্য খুব উপোযোগি বলে মনে হয়-
“পথে এবার নামো সাথী পথে হবে পথ চেনা
জনস্রোতে নানান মতে মনরথের ঠিকানা
আ আ আ হবে চেনা হবে জানা।
অনেক তো দিন গেল বৃথা এ সংশয়ে
এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে...
রবীন্দ্রনাথ অনেক ভেবে চিন্তে কাজ করতেন। তার শত্রুরাও তাকে কখনও হঠকারী,হুজুগে বা অপরিমাণদর্শী বলতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথও গেয়েছেনঃ
“ওরে নতুন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।
কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী হবে না,
ওরে হিসাবী
এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবী?
যেমন করে ঝর্ণা নামে দুর্গম পর্বতে
নির্ভাবনায় ঝাপ দিয়ে পড়, অজানিতের পথে,
জাগবে ততই শক্তি যতই হানবে তোরে মানা,
অজনাকে বশ করে, তুই করবি আপন জনা।
চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী
পায়ের বেগেই পথ কেটে যায় করিস নে আর দেরি।”
গত ২৭ জানুয়ারি ২০১২ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি একটি জাতীয় সমাবেশ ও মিছিল করেছিল। এই সমাবেশ উপলক্ষে পোস্টার দেয়াল লিখন, লাল পতাকার সাজ-সজ্জা ও বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার লাগানো হয়েছিল।
কবি মোহন রায়হান এই আয়োজন দেখে একটি কবিতা লিখেছিলেন,‘লাল মিছিলের ঐক্য’ আমার মনে হয় সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বামপন্থী প্রগতিশীল নেতা কর্মী এবং কোটি মানুষের মনের কথা, আবেগ, আকাক্ষ্মা ও স্বপ্নের কথা কবিতাটির মাধ্যমে চমৎকার ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ।এ স্বপ্ন ও আবেগ আমরা যারা জীবিত আছি শুধু তাদেরই নয় ।আজ প্রয় শত বর্ষ ধরে আমাদের এ ভূখন্ডে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীরা মানব মুক্তির মহান ব্রত নিয়ে যে অসংখ্য গণ-সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। অতুলনীয় আত্মদান ও আত্মউৎসর্গের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । তাদের সবারই ছিল এমনি একটি স্বপ্ন ছিল । পুরা কবিতাটি নিচে উদ্ধৃত করা হলোঃ
লাল মিছিলের ঐক্য
“জমিজমা সম্পদ প্রাচুর্য এমনকি নারী নিয়েও
কি কোনো বিরোধ ছিল কমরেড?
তবু কেন মেঘনার ভাঙনের মতো আমরা অস্তিত্বহীন প্রায়
শুচিতার অহংকার ঠেলে দিয়েছে কোথায় আজ
মানুষের মুক্তির সংগ্রাম?
প্রবল বন্যায় ভাঙা নদীরও তো জেগে ওঠে চর
পলি জমেজমে বন্ধ হয় প্রমত্ত খাঁড়ির মুখ
কমরেড, সূর্যের কণাগুলো জমা করে আমরাও কি
শেষবারের মতো জ্বলে উঠতে পারি না যূথবদ্ধ?
‘সমাজতন্ত্রের দিন আজ শেষ’ যারা বলে তারা বলুক
দারিদ্র শেষ হয়ে গেছে, পৃথিবীর কোথাও ক্ষুধা জরা
অনাহার অপুষ্টি নেই, শোষণ পীড়ন বৈষম্য বিভেদ এই শব্দগুলো
কোনো ভাষার অভিধানেই খুঁজে পাওয়া যাবে না আর।
ওরা বলুকÑ সমতা এসে গেছে ঘরে ঘরে
শ্রম আর ঘামের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বে
মুনাফার বদলে প্রেমের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে
মারণাস্ত্র ছেড়ে গোলাপের চাষ করছে সাম্রাজ্য আগ্রাসীরা
পৃথিবীর একটি শিশুও মারা যাবে না যুদ্ধে
কোনো নারীই আর ধর্ষিতা হবে না বন্দি শিবিরে
কোনো দেশই দখলে যাবে না অন্যদেশের পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষে
কেন খোদ পুঁজির জারজ গর্ভেই জ্বলছে আগুন
দেশে দেশে ফুঁসে উঠছে মানুষ, চলছে ঘেরাও দখল?
কমরেড, জেনো এসব প্রশ্নের কোনো জবাবই নেই ওদের কাছে
কেন তাহলে আমরা এখনও দ্বিধা আর সংশয়ের দোলাচলে?
লাল পতাকার দিন শেষ হবে না কখনো
যতদিন পৃথিবীতে তলপেট চিনচিন করবে ক্ষুধার আগুনে
যতদিন বিশাল আকাশ ছাড়া মাথার ওপরে
আর কিছুই থাকবে না অধিকাংশ মানুষের
নগ্নতা ছাড়া আর কোনো পোশাকই থাকবে না ওদের
অন্ধকার ছাড়া আর কোনো আলো জ্বলবে না নিষ্প্রভ চোখে
যতদিন সমঅধিকারে হেসে উঠছে না প্রবঞ্চিতের ঠোঁট
ততদিন সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন ফুরাবে না কোথাও।
তাহলে বিলম্ব আর কেন
অনেক তো হলো এসো বন্ধু এসো সাথী
পুরোনো তর্ক ফেলে সব বিভেদ অনৈক্য ভুলে
সমুদ্রের মোহনার মতো আমরা একত্র হই
পচা আঙুরের মতো বিচ্যুতদের পিছু ফেলে
কাঁচা পেয়ারার মতো নতুনদের সাথে নিয়ে
আমরা এগিয়ে যাই।
নাচোল থেকে উঠে আসুক হাতুড়ি কাস্তে হাতে অজস্র কিষাণী
পাবনার জেলখানা ভেঙে আসুক প্রমত্ত বিপ্লবী
কাগমারি থেকে বাঁশের লাঠি হাতে দুর্বিনীতি শ্রমিক
সিরাজগঞ্জ থেকে দুর্দান্ত সশস্ত্র গণবাহিনী
ময়মনসিংহ থেকে লাল পট্টি বাঁধা ক্ষেতমজুর
আত্রাই থেকে অগণিত কৃষক
পেয়ারাবাগান থেকে সাহসী গেরিলা
যূথবদ্ধ সমাবেশের প্রগাঢ় আলিঙ্গনে
শুরু হোক নতুন যুদ্ধের সূচনা।
শ্মশানে শায়িত সাম্রাজ্যবাদের চিতায় জ্বেলে দেই
রক্তের আগুনে জ্বালানো দাউ দাউ সুতীব্র মশাল
শেষ হোক শেষ হোক হরিলুট চর্বচোষ্য
প্রতারণাময় বৃত্তাবদ্ধ নাগরদোলার ক্ষমতায়ন।
ঐক্য ঐক্য একমাত্র ঐক্য লাল মিছিলের ঐক্য
শ্রমিকের রক্তেবোনা লাল পতাকাই শেষ সমাধান
লাল সমুদ্রের গর্জমান ঢেউয়ে ভাসিয়ে দাও
পচা শামুকের মতো ভঙ্গুর নষ্ট গলা পুঁজে ভরা
পুঁতিগন্ধময় ব্যর্থ পুঁজিবাদ।
No comments:
Post a Comment