Pages

Monday 25 January 2010

রাখালের কলাম : প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

রাখালের কলাম---------
প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ হইতে ১৩ জানুয়ারি ভারত সফর শেষে দেশে ফিরিয়াছেন। এই সফরের সময় বাংলাদেশের সহিত তিনটি বিষয়ে চুক্তি হইয়াছে এবং দুইটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হইয়াছে। ইহা ছাড়াও সফর, চুক্তি, সমঝোতা, পারস্পরিক আলোচনার বিষয়বস্তুর বৃত্তানন্ত সহকারে একটি যৌথ ইশতেহারও প্রকাশিত হইয়াছে।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর লইয়া অনেক কথাবার্তা হইয়াছে। ভারতের সহিত বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের শীতল এবং কখনও কখনও বৈরী সম্পর্ক এবং নানা বিষয়ে বিরোধ উভয় দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকদের উদ্বিগড়ব করিয়া তুলিয়াছে। আমরা বন্ধু পাল্টাইতে পারি কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টাইবার কোন উপায় নাই। ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক আমাদিগকে প্রতিবেশীদের লইয়াই চলিতে হইবে। আজিকার দিনে একা চলা সম্ভব নহে। সবাইকে লইয়াই চলিতে হইবে। প্রতিবেশীর সহিত সম্পর্ক তিক্ত হইলে তাহা কাহারও জন্য মঙ্গলজনক হইতে পারে না। তাহাতে উভয়ের জীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠে, অগ্রগতি নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

সফর শেষে সরকারী দল আওয়ামী লীগ বলিয়াছে সফর ‘শতভাগ সফল হইয়াছে, বিরোধী দল বিএনপি বলিয়াছে শতভাগ বিফল। ‘শতভাগ’ লইয়া দুই যুদ্ধরত
দলের মধ্যে কোন দ্বিমত নাই। তবে মূল্যায়ন শতভাগ বিপরীত।

ভারত সফর লইয়া বক্তৃতা বিবৃতি আমাদের বাজেট লইয়া পঙতিμিয়ার মতোই। সংসদে বাজেট বক্তৃতা শেষ হইতে না হইতেই সরকারী দলের লোকজন নগর কেন্দ্রে স্বতস্ফূর্ত মিছিল করিয়া বাজেটকে অভিনন্দন জানায়। অপরদিকে বিরোধী দলও সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা জানাইয়া স্বতস্ফূর্ত মিছিল করে। একই দল সরকারী দলে থাকিলে বাজেট লইয়া বিবৃতিতে এক ধরনের কথা বলে আবার বিরোধী দলে থাকিলে আর এক ধরনের বিবৃতি দেয়। এই সব কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন বিষয় সম্পর্কে গভীর ভাবে জানা বুঝার উপায় থাকে না।

সরকার যেমন আগে ভাগেই বলিয়াছিলেন সফর শতভাগ সফল হইবে। স্বয়ং খালেদা জিয়া আগেই হুমকি দিয়াছিলেন যে, শেষ হাসিনা দেশে ফিরিবার পথে কাটা বিছাইয়া রাখা হইবে। এক্ষণে তিনি শেষ হাসিনার পথ কন্টকাকীর্ণ করিবার জন্য কাটা বিছাইতে জোট গঠন করিবেন বলিয়া ঘোষণা দিয়াছেন।

যেই তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে তাহার মধ্যে রহিয়াছে অপরাধীদের দমন করার ব্যাপারে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা প্রদান, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদেও হস্তান্তর, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ এবং অবৈধ মাদক ব্যবসা মোকাবেলার অঙ্গীকার। বিএনপি এই চুক্তির বিরোধীতার কী কারণ হইতে পারে? তাহারা কি সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের দমন করিতে ইচ্ছুক নহে। তাহারা কি দেশের ভিতরে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের লালন করিতে চাহেন। ভারত ও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়ার এক তরফা প্রচারণার কারণে ধারণা করা হয়, যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শুধুমাত্র বাংলাদেশের ব্যাপার। বস্তুত বাংলাদেশ হইতে ভারতে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী রফতানি করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। ভারত উহাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশে উলে−খযোগ্য ভাবে সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব হইবার বহু পূর্ব হইতেই কাশ্মিরি ও তামিল, নকশাল, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী বা অধুনা মাওবাদীদের কথা আমরা জানি। ভারতের নিকট বরং আমাদের দাবি হইবে যে তাহাদের সন্ত্রাসীদিগকে তাহারা সামলাক। উহারা কেন আমাদেও দেশে আসিয়া তৎপরতা চালাইবে। ভারত উহাদের ঠেকাক। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরাও ভারতে যাইয়া আশ্রয় লইয়া ছিল। শেখ হাসিনা শান্তি চুক্তিতে সই করিবার পর হাজারে হাজারে তাহারা বাংলাদেশে ফিরিয়া আসিয়াছে। পার্বত্য এলাকার কয়েক যুগের যুদ্ধাবস্থার অবসান হইয়াছে। কিন্তু বিএনপি জামাত পার্বত্য চট্টগ্রাম লইয়া যে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিয়াছে, তাহাতে মনে হয় তাহারা চাহেন বিদ্রোহীরা ভারতে থাকিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে থাকুক। বিএনপি জামাত সরকারের সময়ই চট্টগ্রাম বন্দরে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়িয়াছিল। বগুড়ায় কয়েক লক্ষ গুলি আটক হইয়াছিল ইহাছাড়া কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে খালাস করা অস্ত্র ধরা পড়িয়াও উধাও হইয়া গিয়াছিল। এখন জানা যাইতেছে সরকারের সামরিক বেসামরিক উচ্চ পর্যায়ের লোকজন মায় মন্ত্রী পর্যন্ত উহাতে জড়িত ছিল। বিএনপি জামাত সরকার কাহার পক্ষ হইয়া ভারতের বিরুদ্ধে নামিয়াছিলেন? উহাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কি ভাবে রক্ষিত হইয়াছিল। হয়তোবা পাকিস্তানের স্বার্থ হাসিল হইয়াছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফের সহিত ঢাকার হোটেল শেরাটনে বন্দী অনুপ চেটিয়ার গোপন বৈঠকের আয়োজন কেন করা হইয়াছিল? বিএনপি কোন দেশের বিদ্রোহী বা স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করিতে চায়, করিতে পারে। বুকের পাটা থাকিলে প্রকাশ্যে উক্ত রূপ অবস্থান গ্রহণ করেন না কেন? কমিউনিস্টরা তো ভিয়েতনামের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরিয়া প্রকাশ্য অবস্থান লইয়াছিল। সেই কারণে এমনকি কোনো কোনো সময় আওয়ামী মহলেরও হামলার শিকার হইতে হইয়াছে কিন্তু কমিউনিস্টরা কোনোদিন পিছু হটে নাই। আসলে মনে হয়, বিএনপি-জামাত গোষ্ঠী আজ বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, পাকিস্তানের স্বাথের্ই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দন্দ্ব সংঘাত জিয়াইয়া রাখিতে চায়।

সমঝোতা স্মারকে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার কথা বলা হইয়াছে। ৫০ দফার যৌথ ইশতেহারের ৩২ নম্বর দফায় বলা হইয়াছে যে ভারত বাংলাদেশকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেবে এবং দুইদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিনিময় এবং ইন্টারগ্রিড সংযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগীতা জোরদার করা হবে। আমাদের দেশে বর্তমান বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা সবাই জানেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে নিকটাতীতের সরকারের ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি সময় সাপেক্ষ হওয়ার কারণে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ হইতে বিদ্যুৎ আমদানী করিতে বাধ্য হইতেছি। আমরাও কোনো স্থানে বিদ্যুৎ বাড়তি হইলে গ্রীড সংযোগের মাধ্যমে পারস্পরিক সুবিধার্থে বিদ্যুৎ বিনিময় করিতে হইবে। বিএনপি বলিয়াছে ভারত যদি হঠাৎ করিয়া বিদ্যুৎ বন্ধ করিয়া দেয় তাহা হইলে আমরা অচল হইয়া যাই। প্রবীণ নেতাদের মুখে এইসব বালখিল্য হাসি সম্বরন করা দূষ্কর। ভারত হইতে অন্যান্য দেশ হইতে আমরা কতই না জরুরী জিনিসপত্র আমদানী করিতেছি। উহারা যদি হঠাৎ করিয়া উহা বন্ধ করিয়া দেয়? তাহা হইলে কি আমরা সবার সহিত ব্যবসাবাণিজ্য-লেনদেন বন্ধ করিয়া দিব? বর্তমান সরকারের দায়িত্ব কথা কম বলিয়া, শুধুমাত্র আগের সরকারের ব্যর্থতার বিবরণ না দিয়া বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাইতে দেশের ভিতরে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জরুরি ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

এই সফরের সময় সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করিবার জন্য সমঝোতা হইয়াছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা বহুকাল আগে হইতেই চলিয়া আসিতেছে। শুধু ভারত কেন অন্যান্য দেশের সহিত ও আমাদের সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা চলিতেছে। কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের যুগে কোনো দেশের সংস্কৃতিকেই আর দেওয়াল দিয়া আটকিয়ে রাখা যায় না। আমাদের দুই দেশেরই কতগুলি সাধারণ ঐতিহ্য আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই দেশেরই কবি। তাহার ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উৎসব পালনে দুই দেশ একত্রে কাজ করিবে। সাংস্কৃতিক লেনদেন নানাভাবে চলিতেছে। দুই দেশের সরকারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা অপসংস্কৃতি রোধে এবং সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারে। তবে ইহাও মনে রাখা দরকার, প্রতিটি চুক্তি ও সমঝোতার অনেকগুলি দিক আছে। বাস্তবায়নের সময় সামগ্রিকভাবে তাহা তদারক ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, বই, পুস্তক টিভি চ্যানেল ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে নানা প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। ভারতকে সেই বাধা ও সমস্যাগুলি দূর করিবার বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

যৌথ ইশতেহারে মংলা এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর রেল ও সড়ক পথে মাল আনা নেওয়ার জন্য ব্যবহারের ভারতকে অনুমতি দেওয়া হয়। নেপাল, ভুটানও ভারতের কিছু এলাকা অতিμম করিয়া বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলি ব্যবহার করার সুযোগ পাইবে। শেখ হাসিনা বলিয়াছেন মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর দুইটি আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে গড়িয়া তোলা হইবে। উহার জন্য অবকাঠামো গড়িয়া তুলিতে যে ব্যয় হইবে ভারতও তার কিছু দায়িত্ব লইবে। বন্দর যাহারাই ব্যবহার করিবে তাহাদের বাংলাদেশকে নির্ধারিত অর্থ দিতে হইবে। ইহার ফলে বাংলাদেশেরও বন্দর হইতে আয় বৃদ্ধি পাইবে। ইহার আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বলিয়াছেন চীনও চট্টগ্রাম বন্দও ব্যবহার করবে। বন্দর বাংলাদেশেরই থাকিবে। নিয়ন্ত্রণও বাংলাদেশের হাতে থাকবে। অন্যরা বন্দর ব্যবহার করিলে যাহাতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি না হয়। নিরাপত্তা বিঘিড়বত না হয় তাহাও দেখার দায়িত্ব ও ক্ষমতা থাকিবে বাংলাদেশ সরকারের। খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা যখন চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি ভূয়া বিদেশি কোম্পানির কাছে লিজ দিতে চাহিয়াছিল তখন কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরা তাহার প্রবল বিরোধিতা করিয়াছিল। খালেদা জিয়া তখন নিজের দলিলে স্বাক্ষর করিয়া দিয়াছিলেন। এখন বাংলাদেশের মালিকানা ন নিয়ন্ত্রণে রাখিয়া চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও বেশি ব্যবসা দিবার ব্যাপারে তাহার আপত্তি কী কারণে বোঝা কঠিন।

যৌথ ইশতেহারে উভয় দেশ পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ, যাতায়াত, পরিবহন, কানেকটিভিটি, পর্যটন ও শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিও অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। যৌথ ঘোষণার সকলের মঙ্গলের জন্য ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সকল সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। ৫০ দফা যৌথ ইশতেহারে নানা বিষয়ে উলে−খ করা হইয়াছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের জমিয়া ওঠা সমস্যা ও বিরোধের বিষয়ও উলে−খ করা হইয়াছে। কিছু কিছু বিষয়ে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিলেও অনেকগুলি ব্যাপারে সুস্পষ্টই কিছু বলা হয় নাই। যেমন টিপাইমুখ বাঁধ লইয়া ভারত বলিয়াছে, তাহারা এমন কিছু করবে না যাহা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হইতে পারে। ইহা একটি সাধারণ কথা। পাকিস্তান, আমেরিকা বা ইসরাইলও এই রূপ লিখিয়া দিতে দ্বিধা করিবে না। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুসাওে বাংলাদেশের দাবি হইবে ভারতে টিপাইমুখ প্রকল্প চালু করিবার আগে উহার μিয়া-পতিμিয়া সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশকে সরবরাহ করিতে হইবে। ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সম্মতি পাইবার পূর্বে ভারত টিপাইমুখ লইয়া অগ্রসর হইবে না। ৫৪টি অভিনড়ব নদীর ব্যাপারে ভারতের অনুরূপ ভূমিকা থাকাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ভারত একতরফা ভাবে ফারাক্কা বাধ নির্মাণ করিয়াছে। তিস্তা বাধ করিয়াছে। শেখ হাসিনা ভারত যাওয়ার আগেই তিস্তার পানি লইয়া বিরোধ নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে বলিয়া শুনিয়াছিলাম। কিছুই হইল না। এইসব ভালো লক্ষণ নহে। সীমান্ত সমস্যা দীর্ঘদিনের। ’৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ কার্যকর করিয়াছিল ভারত করে নাই। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর ঘটনা প্রায়শই ঘটিতেছে। ছিটমহলগুলি লইয়া বিরোধও দীর্ঘদিনের। ইহাছাড়া সমুদ্রসীমা লইয়া বিরোধ মীমাংসাও জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে বার্লিন ওয়ালের মতো তারকাটার বেড়া দিতেছে। তাহা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়িয়া ভারতে মাদক উৎপাদনের কারখানা গড়িয়া উঠিতেছে। সেখান হইতে কোটি কোটি টাকার মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে পাচার হইতেছে। বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকরা বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাইতেছে, কিন্তু যাহারা ভারত হইতে সংগঠিতভাবে মাদক পাচার করিতেছে ভারত সীমান্তে বিএসএফ তাহাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেছে না।

সীমান্ত সমস্যাসহ বিভিনড়ব সমস্যাই যৌথ ইশতেহার উলি−খিত হইয়াছে। কিন্তু সমস্যাগুলি সমাধানে পরবর্তীকালে কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাহাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশের পক্ষ হইতে ভারতের সহিত যাহারা আলোচনা করিবেন তাহাদিগকে বিষয়বস্তুর অদ্যপান্ত সম্পর্কে জ্ঞান আলোচনায় দক্ষতা অর্জন করিতে হইবে এবং কোন প্রশেড়ব দৃঢ় হইতে হইবে, কোন প্রশ্নের ছাড় দেওয়া চলিবে তাহাও বুঝিতে হইবে।

ভারত একটি বৃহৎ ধনিক রাষ্ট্র। বৃহৎ এবং তুলনামূলকভাবে উনড়বত হওয়ার ফলে তাহার বিশেষ কিছু সুবিধাও আছে। উহার সুযোগ লইয়া প্রতিবেশী ছোট দেশগুলিকে সে যদি চাপিয়া রাখিতে চায় তাহা হইলে সেইসব দেশের সহিত সুসম্পর্ক গড়িয়া ওঠা কঠিন। এক্ষণে লক্ষ করিলে দেখা যাইবে ভারতের সহিত তাহার প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কাহারও সম্পর্ক তেমন ভালো নহে। ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য সমর্থন লইয়া বাংলাদেশের জনগণ দেশ স্বাধীন করিয়াছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলেই আমরা বাংলাদেশভারত সম্পর্কের অবনতি লক্ষ করিয়াছি। পরবর্তীতে বাংলাদেশে পঙতিμিয়াশীল পাকিস্তানি মতাদর্শের লোকজন ক্ষমতা দখল করিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। তবে সামগ্রিকভাবে দেখিলে দুই দেশের পক্ষ হইতেই কতগুলি নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছিল। আই কে গুজরাল যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমরা তখন দিল−ীর সহিত প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্কের কিছু উনড়বতি লক্ষ করিয়া ছিলাম। এমনকি সেই সময় দিল−ীর সহিত ভারতের রাজ্যগুলির সম্পর্কেও উনড়বতি ঘটিয়াছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলিয়াছেন, ভারতকে আরও বেশি উদার হইতে হইবে।

সম্প্রতি ভারত তাহার জোট নিরপেক্ষ নীতি হইতে সরিয়া গিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি করিয়াছে। ভারত-মার্কিন- ইসরাইল স্ট্র্যাটেজিক মৈত্রী গড়িয়া উঠিয়াছে। ভারতীয় বামপন্থীরা এই কারণে কংগ্রেস নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করিয়াছিল। ভারতের জন্য ঐ সকল চুক্তি যেমন বিপজ্জনক তেমনি বাংলাদেশ ও এতদঞ্চলের দেশগুলির জন্যও বটে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করিয়া পাকিস্তানি রণনীতি কার্যকর করিবার প্রচেষ্টা যেমন প্রতিহত করিতে হইবে তেমনি ভারতকে ব্যবহার করিয়া মার্কিন ও ইসরাইলি সাম্রাজ্যবাদী রণনীতি যাহাতে কেহ কার্যকর করিবার চেষ্টা না করে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে।

শতভাগ সফল অথবা শতভাগ বিফল এই কুতর্কে না গিয়া ইহা বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়া উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়িয়া তুলিবার কিছু সুযোগ সৃষ্টি হইয়াছে। আগামীতে সুনির্দিষ্টভাবে উহা কতটা কাজে লাগানো যাইবে তাহার উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। যাত্রা শুরু হইয়াছে- এখনও অনেক পথ বাকি- অনেক প্রতিবন্ধকতাও আছে।

No comments: