Pages

Wednesday 5 January 2011

মুক্তিযুদ্ধ চলছে

মুক্তিযুদ্ধ চলছে
মনজুরুল আহসান খান

১৬ ডিসেম্বর বাঙালি তথা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বিজয়ের দিন। গৌরব ও অহঙ্কারের দিন। এই দিন আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দখলদার বাহিনী থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত করেছিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পাকিস্তানের আধুনিক ও শক্তিশালী সেনা বাহিনী সেদিন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

বাংলাদেশের সংগ্রামকে আমরা শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম বলি না, মুক্তিযুদ্ধও বলি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ’৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়। শুধুমাত্র একটি পতাকা বা নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীতের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। পাকিস্তান যে মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং সামরিক স্বৈরশাসনের ধারায় চলেছিল। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। শত বছরের ধারাবাহিকতায় ও বহু গণসংগ্রামে অসংখ্য মানুষে আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপড়ব, আদর্শ ও লক্ষগুলি ধীরে ধীরে দানা বেঁধে ওঠে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয় কিন্তু এই শক্তির অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। পেটি বুর্জোয়ার মধ্যস্তরের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা এর পেছনে কাজ করেছে। বাংলাদেশের আদর্শ ও লক্ষ্যসমূহের একনিষ্ট ধারক ছিল কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। কমিউনিস্ট পার্টি এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা, দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল কমিউনিস্টরাই। সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে, কৃষক, শ্রমিক, নারী, ছাত্র, পেশাজীবী আপামর জনতার লড়াই ও সংগঠন গড়ে তুলেছে কমিউনিস্টরাই। তাদের সে লড়াইয়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে আওয়ামী লীগ, অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি ও গোটা সমাজের মধ্যে। কমিউনিস্টরা চরম দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। ’৭৫-এর জেল হত্যার বহু আগেই ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি করে ৭ জন কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট, ন্যাপ প্রভৃতি বাম প্রগতিশীল শক্তির বিশাল গণসংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হওয়ার পটভূমি সৃষ্টি করেছে। গোটা আন্দোলনে শুধু স্বাধীনতা না, আমাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তি এবং একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং কর্মসূচি সম্পৃক্ত হয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ একদিনে বা শুধু একটি দাবিতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের গণসংগ্রামের পরিণতি। তেভাগা আন্দোলন, টংক, নানকার প্রভৃতি প্র ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, নাচোলে আদিবাসীদের বিদ্রোহ, ’৪৮-এর ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফাভিত্তিক নির্বাচনী সংগ্রাম, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬-দফা সংগ্রাম ও ১১- দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-নারী-ছাত্র-জনতার বিভিনড়ব গণসংগ্রাম, ’৭০ ও ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সুরক্ষার সংগ্রাম, গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে এবং প্রগতিশীল বিকাশের দাবিতে আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তানের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে এই সব অসংখ্য গণসংগ্রামের নদ-নদী ও স্রোতধারাগুলি মুক্তিযুদ্ধের মহাসমুদ্রে মিলিত হয়ে এক মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি পৃ ক এবং স্বাধীন দেশ, একটি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের জন্য জন্ম নেয়নি। পাকিস্তান থেকে পৃ ক হয়ে একটি ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ সৃষ্টি করার জন্যও বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেয়নি।

পাকিস্তান ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শ্রেণী ছিল বড় পুঁজিপতি এবং বৃহৎ ভূস্বামী। পুঁজিবাদী ধারায় দেশ পরিচালিত হতো। তারা দেশের শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের উপর শোষণ চালাত। তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালি, পাঠান, বেলুচ প্রভৃতি জাতিগুলির উপরও জাতিগত শোষণ চালিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান জোটবদ্ধ ছিল। সিয়াটো, সেন্টো প্রভৃতি পাকমাকির্ন সামরিক চুক্তির সাথে পাকিস্তান আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা ছিল। পাকিস্তানে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি। বারবার সামরিক একনায়ক ক্ষমতা দখল করেছে। এটাই ছিল পাকিস্তানি ধারা।

তার বিপরীতে বাংলাদেশের ধারা এবং চেতনা ও রূপকল্প ছিল সম্পূর্ণ ভিনড়ব। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে ধর্ম ও বিবেকের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো সুযোগ থাকবে না। যেখানে ধর্ম, জাতি, গোত্রের কারণে কারও প্রতি কোনো বৈষম্য অবিচার থাকবে না। পাকিস্তানের ২৪ বছর পুঁজিবাদী পথে চলায়, দেশের অর্থনীতি সঙ্কটগ্রস্ত হয়েছে, ধন বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য ও জনজীবনের সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ সেই পুঁজিবাদের পথে হাঁটবে না।

পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের শোষণ করা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়নি, ছাত্রসমাজ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই সব শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশের-শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির উপর জাতিগত শোষণ চালিয়েছে। তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে যাতে বাংলাদেশের উপর আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশের শোষণ আধিপত্য চাপতে না পারে। যাতে বাংলাদেশের ভেতরেও যে সমস্ত জাতিগত সংখ্যালঘু আছে তারাও শোষণ-বঞ্চনার শিকার না হয়। তাদের সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষার অধিকার যাতে স্বীকৃত হয়।

আমেরিকা ছিল মানবতার সবচেয়ে বড় দুশমন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমেরিকা পাকিস্তানকে সেদিন সবরকম সমর্থন দিয়েছিল। ওরা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে দমন করার জন্য শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র-সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন অবস্থান নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকার জন্য, সাম্রাজ্যবাদের কথা মতো চলার জন্য নয়।

পাকিস্তানে কোনোদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিভিনড়ব পর্যায়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। তারা নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থা বিকশিত হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। স্বাধীন-বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে, বারবার সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করবে না, এটাই ছিল দেশবাসীর আশা।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়’ একটি নতুন ধারার স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। যে স্বপড়ব যে আদর্শ-লক্ষ্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সে সবের অনেকটাই আমাদের ’৭২-এর সংবিধানে বিধৃত। বিধৃত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে আছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র।

কিন্তু আমরা স্বাধীনতার পর উপর্যুক্ত লক্ষ্যে না এগিয়ে পাকিস্তানি ধারার দিকেই পিছু হটেছি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সেই ধারা আরো শক্তিশালী হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্রের জন্য যেমন দায়ী তেমনি এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তিগুলির ব্যর্থতাও বহুলাংশে দায়ী।

ধনিকশ্রেণীর দলগুলি, সঠিকভাবে বললে লুটেরা ধনিকশ্রেণী ব্যর্থ হয়েছে, লুটপাট, দুর্নীতি, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ধারা অনুসরণ করার কারণে। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র তো আছেই। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারাকে যে সব শক্তি দৃঢ় ও নিরবচ্ছিনড়বভাবে এগিয়ে নিতে পারে সেই কমিউনিস্ট বাম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি জনগণের আস্থাভাজন কোনো বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে পারেনি। দেশ ধনিকশ্রেণীর পাতা ফাঁদ দ্বিদলীয় মেরুকরণ বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। জনগণের নজরও মন্দের ভালোর দিকে। ভালোর মন্দ দিক ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। দ্বিদলীয় মেরুকরণের রাজনৈতিক চোরাবালি থেকে যখন মানুষ মুক্তি চায় তখন বারবার তৃতীয় শক্তি হিসেবে সামরিক বাহিনীর অবির্ভাব ঘটে। জনগণের মধ্যেও চলতি রাজনীতি নিয়ে এত বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় যে তখন তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং সামরিক শাসনকে তারা অবশ্যম্ভাবী মনে করে। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীন বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময়ই সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাসন ছিল, অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই চূড়ান্ত রূপ। আমরা পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখি সামরিক শাসন কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। পাকিস্তান এবং তার সামরিক বাহিনী আজ ধ্বংসের কিনারায়। বাংলাদেশেও সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস সুখকর নয়। এর ফলে দেশের রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক বিকাশ ধারা বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। সেনাবাহিনীও যারপর নাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক-এগারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও ধনিক শ্রেণীর কোনো বোধদয় হয়নি। যে সংঘাত ও সংঘর্ষ এক-এগারো সৃষ্টি করেছিল সেদিকেও যেন দেশ যাচ্ছে।

বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারবে কিনা তার উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখনও চলছে।

লেখক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিরি’র সভাপতি।

No comments: