Pages

Wednesday 1 February 2012

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মনজুরুল আহসান খান

বাংলাদেশের প্রায় সবাই বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সাধারণ মানুষও চায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই কারণে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দল ও নেতার প্রধান স্লোগান এটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বাস্তবে কি বোঝায় এবং কিভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে অনেকেই তেমন কিছু বলেন না।

এইসব শব্দগুলি বাস্তব থেকে জন্ম নেয় কিন্তু নানা কারণে প্রায়শই এই শব্দগুলি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘বাত কে বাতে’ পর্যবসিত হয়। স্লোগানটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়। গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এসব কথাও আজ এমন সব শক্তির জিগিরে পরিণত হয়েছে যারা এসব আদর্শের বড় শত্রু। সম্প্রতি উইকিলিকস কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়ায় ‘স্বচ্ছতার’ শিক্ষকরা কতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেছে তা সারা বিশ্বই দেখতে পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথাও যারা বলছেন তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিপরীতে কাজ করছেন। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বিশ্বাসও করেন না। তা নাহলে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলতে যা বোঝায় তাদেরকে পরাভূত করে পাকিস্তানি ধারায় দেশকে ঠেলে দেয়া সম্ভব হতো না।

ক্ষমতাসীন শ্রেণী তার নিজ স্বার্থে-ক্ষমতা, আধিপত্য, শোষণ ও লুটপাটের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গভীরে যেতে চায় না এবং বিশেষত তার আর্থ-সামাজিক দিক নির্দেশনা আড়াল করার চেষ্টা করে। এ দেশের জনগণের হাজার বছরের বহুমাত্রিক সংগ্রাম যা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয় সে ইতিহাসকে এক পেশে, একমাত্রিকতায় বা নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা দলীয় ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। জনগণের সাথে যতদিন এমনি প্রতারণা করা হবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন সংগঠিত শক্তি থেকে মুক্ত করে সক্রিয় সংগ্রামে এগিয়ে যেতে না পারবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথাযথ প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশের সংগ্রামকে আমরা শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম বলি না, মুক্তিযুদ্ধও বলি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ’৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়। শুধুমাত্র একটি পতাকা বা নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীতের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। পাকিস্তান যে মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং সামরিক স্বৈরশাসনের ধারায় চলেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। শত বছরের ধারাবাহিকতায় ও বহু গণসংগ্রামে অসংখ্য মানুষে আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন, আদর্শ ও লক্ষ্য গুলি ধীরে ধীরে দানা বেঁধে ওঠে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয় কিন্তু এই শক্তির অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। পেটি বুর্জোয়ার মধ্যস্তরের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা দ্বিধা দ্বন্দ্ব এর পেছনে কাজ করেছে। বাংলাদেশের আদর্শ ও লক্ষ্যসমূহের একনিষ্ঠ ধারক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও বামপন্থীরা। কমিউনিস্ট পার্টি এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা, দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল কমিউনিস্টরাই। সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে, কৃষক, শ্রমিক, নারী, ছাত্র, পেশাজীবী আপামর জনতার লড়াই ও সংগঠন গড়ে তুলেছে কমিউনিস্টরাই। তাদের সে লড়াইয়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে আওয়ামী লীগ, অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি ও গোটা সমাজের মধ্যে। কমিউনিস্টরা চরম দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। ’৭৫-এর জেল হত্যার বহু আগেই ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি করে ৭ জন কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়েছিল। মওলানা ভাষানী, মণি সিংহ প্রমুখের নেতৃতে কমিউনিস্ট, ন্যাপ প্রভৃতি বাম প্রগতিশীল শক্তির বিশাল গণসংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করার পটভূমি সৃষ্টি করে। গোটা আন্দোলনে শুধু স্বাধীনতা নয়, আমাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তি তথা সমাজতন্ত্র এবং একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং কর্মসূচি সম্পৃক্ত হয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ একদিনে বা শুধু একটি দাবিতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের গণসংগ্রামের পরিণতি। তেভাগা আন্দোলন, টংক, নানকার প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল, গারো, হাজং, নাচোলে আদিবাসীদের বিদ্রোহ, ’৪৮-এর ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তি সংগ্রাম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফাভিত্তিক নির্বাচনী সংগ্রাম, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬-দফা সংগ্রাম ও ১১-দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-নারী-ছাত্র-জনতার বিভিন্ন গণসংগ্রাম, ’৭০ ও ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সুরক্ষার সংগ্রাম, গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে এবং প্রগতিশীল বিকাশের দাবিতে আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণসংগ্রাম প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তানের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে এই সব অসংখ্য গণসংগ্রামের নদ-নদী ও স্রোতধারাগুলি মুক্তিযুদ্ধের মহাসমুদ্রে মিলিত হয়ে এক মহাপ¬াবন সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে স্বাধীনকে দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

পাাকিস্তান ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শ্রেণী ছিল বড় পুঁজিপতি এবং বৃহৎ ভূস্বামী। পুঁজিবাদী ধারায় দেশ পরিচালিত হতো। দেশের শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের উপর শোষণ চলত। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালি, পাঠান, বেলুচ প্রভৃতি জাতিগুলির উপরও জাতিগত শোষণ চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান জোটবদ্ধ ছিল। সিয়াটো, সেন্টো প্রভৃতি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির সাথে পাকিস্তান আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল। পাকিস্তানে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হতে দেয়া হয়নি। নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে। বারবার সামরিক একনায়করা ক্ষমতা দখল করেছে। এটাই ছিল পাকিস্তানি ধারা।

তার বিপরীতে বাংলাদেশের ধারা এবং চেতনা ও রূপকল্প ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে ধর্ম ও বিবেকের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো সুযোগ থাকবে না। যেখানে ধর্ম, জাতি, গোত্রের কারণে কারও প্রতি কোনো বৈষম্য অবিচার থাকবে না। পাকিস্তানের ২৪ বছর পুঁজিবাদী পথে চলায়, দেশের অর্থনীতি সঙ্কটগ্রস্ত হয়েছে, ধন বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য ও জনজীবনের সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ সেই পুঁজিবাদের পথে হাঁটবে না।

পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের শোষণ করা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়নি, ছাত্রসমাজ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত চাকুরি, নিরাপত্তা ও ভদ্র জীবনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই সব শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশের-শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির উপর জাতিগত শোষণ চালিয়েছে। তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে যাতে বাংলাদেশের উপর আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশের শোষণ আধিপত্য চাপতে না পারে। যাতে বাংলাদেশের ভেতরেও যে সমস্ত জাতিগত সংখ্যালঘু আছে তারাও শোষণ-বঞ্চনার শিকার না হয়। তাদের সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষার অধিকার যাতে স্বীকৃত হয়।

আমেরিকা ছিল মানবতার সবচেয়ে বড় দুশমন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমেরিকা পাকিস্তানকে সেদিন সবরকম সমর্থন দিয়েছিল। ওরা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে দমন করার জন্য শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র-সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন অবস্থান নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকার জন্য, সাম্রাজ্যবাদের কথামতো চলার জন্য নয়।

পাকিস্তানে কোনোদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে ষড়যন্ত্রের চক্রান্তের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। তারা নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থা বিকশিত হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে, বারবার সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করবে না এটাই ছিল দেশবাসীর আশা। মৌলিক মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন, অধিকার, খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান প্রভৃতির জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত হবে জনগণ সেই আশা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়’ একটি নতুন ধারার স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। যে স্বপ্ন যে আদর্শ-লক্ষ্য ও চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সে সবের অনেকটাই আমাদের ’৭২-এর সংবিধানে বিধৃত। বিধৃত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে। মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র।

কিন্তু আমরা স্বাধীনতার পর উপর্যুক্ত লক্ষ্যে না এগিয়ে পাকিস্তানি ধারার দিকেই পিছু হটেছি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সেই ধারা আরো শক্তিশালী হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র সে জন্য যেমন দায়ী তেমনি এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তিগুলির ব্যর্থতাও বহুলাংশে দায়ী।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। এবার বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হওয়ার পর দেশের মানুষ আশা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে আমরা দ্রুত এগিয়ে যাব।

কিন্তু সেই চেতনা ও আদর্শ নিয়েও শাসক দলের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব সংশয় বিরাজ করছে। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ’৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেয় নি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত ৫ম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করায় বস্তুত ৭২-এর সংবিধান বহাল হয়ে গেছে। বিস্ময়ের বিষয় শাসক দলের অনেকেই এখন বলছেন চার মূল নীতি বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র আজকের দিনে বাস্তব সম্মত নয়।

বস্তুত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়েছিল বটে কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণ দখল করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে নতুন করে গড়ে তোলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই ধারাবাহিকতায় কম-বেশি থেকে গেল। রাষ্ট্র ক্রমশই জনগণের আশা আকাক্সক্ষার বাহক না হয়ে গণবিরোধী চরিত্র ধারণ করল। শোষণ বঞ্চনা নিপীড়নের ফলে হতাশাগ্রস্ত মানুষের বিক্ষোভকে কাজে লাগাল সম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ী, পাকিস্তানপন্থী ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল দেশি-বিদেশি মহল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তি ও দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল মহলের সাথে নমনীয় ও আপসনীতি গ্রহণ করল। এসবেরই প্রতিফলন ছিল তাড়াহুড়া করে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান, শেখ সাহেবের পাকিস্তান সফর, ব্যক্ত অব্যক্ত নানা শর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকে বিপুল আর্থিক সহায়তা গ্রহণ ও সম্পর্ক বৃদ্ধি, দেশের ভেতরে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য অন্য ধারার তুলনায় বেশি অর্থ বরাদ্দ, ধর্মব্যবসায়ীদের নানাভাবে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা এবং পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলির প্রতি নরম নীতি গ্রহণ। অবশ্য এসবের ফলে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াপন্থীরা মোটেই নরম হয়নি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ও প্রগতিশীল শক্তির উপর বর্বর নির্যাতন তার প্রমাণ। এখনো ‘লাইলাহা ইল¬ালাহ্, নৌকার মালিক তুই আল¬াহ’ অথবা শিক্ষানীতিতে সংবিধান অনুসারে একধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু না করে মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ধনীদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে বজায় রাখা ও প্রসারিত করা বা ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ‘বিসমিল¬াহ’ এর বিষয়গুলি ‘স্পর্শকাতর’ বলে ঘোষণা সেই একই তোষামোদীর পুনরাবৃত্তি।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কেও এখন বলা হচ্ছে যে তা বাস্তবসম্মত নয়। অবশ্য স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই খন্দকার মোশতাক সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা এবং পুঁজিবাদী পথ গ্রহণের কথা বলে এসেছিল। মোশতাক সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও ভারতের বিরোধিতা এবং আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার সপক্ষে ছিলেন। মোশতাক অবশ্য প্রবাসী সরকারে মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিলুপ্তির পরও সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়নি। ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ও সরকার তাদের নিজেদের মতো করে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে সাম্প্রতিককালে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সঙ্কট ও বিপর্যয় তা একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাকেই আরো শক্তিশালী করেছে। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগ সেই সমাজতন্ত্রকে দূরবর্তী লক্ষ্য হিসেবেও রাখতে রাজি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী বিশ্বের সাথে গাঁটছড়া বাধা আমাদের দেশের সাম্প্রতিককালের সরকারগুলি বাজার অর্থনীতির দর্শন এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশন অনুসারে দেশ চালাচ্ছে। তাদের শ্রেণী স্বার্থের সাথেও চলমান পুঁজিবাদী ধারা সঙ্গতিপূর্ণ। সমাজতন্ত্র তাদের কাছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। এদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছে তারাই। তাদের চোখে ছিল ‘শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ‘৭২-এর সংবিধান। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর শোষণ ও বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। অথচ ’৭২ এর সংবিধানে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতা অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ীÑ এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক স্বীয় ক জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’ সংবিধানে আরো বলা হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ‘জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন...’ ‘অন্ন্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা চিকিৎসাসহ জীবন ধারনের মৌলিক উপকরনের ব্যবস্থা।’

আজ দেশে কোটি কোটি বেকার, শ্রমিক কর্মচারীরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয় অপ্রতিহত। সরকারগুলোর নীতি হচ্ছে জনস্বার্থের বিপরীতে ধনিক বণিকদের স্বার্থে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে জাতীয়তাবাদ নিয়ে অবশ্য শাসক শ্রেণীর আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের স্বাধীকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছে তা হচ্ছে বিদেশী শাসন-শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র... সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ আমাদের দেশের সরকারগুলি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তো দূরের কথা তাকে তোয়াজ তোষামোদ করে চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশ বহুজাতিক কোম্পানির সাথে গোপন ও প্রকাশ্য নানা সমঝোতা ও চুক্তিতে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন ৭ম নৌবহর দিয়ে শেষ আঘাত হানতে চেয়েছিল।

গণতন্ত্র নিয়েও শাসক শ্রেণীর আপত্তি নেই। তারা বরং কে বেশি গণতান্ত্রিক তা প্রচার করতে ব্যতিব্যস্ত । কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশে গণতন্ত্র হচ্ছে নামমাত্র আনুষ্ঠানিক বা মামুলি। কয়েক বছর পর পর নির্বাচন। অর্থ ও পেশি শক্তির দাপট এবং প্রায়শ কারসাজির নির্বাচনে আমাদের একজন একনায়ক ঠিক করা হয়। দলে, সমাজে কোনো ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। জনগণের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে ব্যক্তির ক্ষমতায়ন চলে। স্থানীয় সরকারের অধিকার ও ক্ষমতা দারুণভাবে সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিপন্ন। দমন পীড়ন, সরকারি সন্ত্রাস, ক্রসফায়ার, বন্দী অবস্থায় নিষ্ঠুর নির্যাতন, মৌলিক অধিকার হরণ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজি, দলবাজি সন্ত্রাস চলছেই। তারপরও গণতন্ত্রের যে খোলস যে আনুষ্ঠানিকতা তাও ঠিক থাকছে না। সঙ্কট সংঘাত সংঘর্ষের মুখে ক্ষমতায় আসছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনী বা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক বা সুশীল সমাজের সরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়েছি তা কিন্তু কিছুদিন পর পর সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পাকিস্তানি ধারা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অধিকাংশ সময়ই আমরা বস্তুত সামরিক শাসনের অধীনেই ছিলাম।

গণতন্ত্র কিন্তু বহুমাত্রিক। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, মালিকানা, কৃষি ভূমি, সর্বক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিকতা বিকশিত না হলে রাজনৈতিক গণতন্ত্রও অন্তঃসারশূন্য ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যা সুনির্দিষ্টভাবে বিধৃত আমাদের ’৭২ এর সংবিধানে বিশেষত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে আমাদের সত্যিকার ইতিহাসের মধ্যে, সামগ্রিক বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অনেকেই আজ আর তেমন করে আগ্রহী নয়। শাসক শ্রেণীর শ্রেণীগত ও সামাজিক সীমাবদ্ধতাই এর জন্য দায়ী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন যে সব ব্রাত্যজনের স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাদের নেতৃত্বে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ শহীদদের স্বপ্নগুলি বাস্তবায়িত করতে পারে।
লেখক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সভাপতি।

No comments: