Pages

Sunday 18 October 2009

রাখালের কলাম : জঙ্গিবাদের চাইতে বড় বিপদ "মাওবাদ"

রাখালের কলাম____________
জঙ্গিবাদের চাইতে বড় বিপদ মাওবাদ!

হঠাৎতন্ত্রের দেশে, হঠাৎ করিয়াই দেখিতেছি, জঙ্গিবাদের চাইতে যেন মাওবাদই বড় বিপদ হিসাবে দেখা দিয়াছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর অস্ত্রপাতিসহ জঙ্গি ধরার হিড়িক পরিয়া গিয়াছিল। সংবাদপত্র ও টিভি পর্দায় ছবিসহ লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশিত হইল। জঙ্গিবাদের বিপদের কথা বলিতে বলিতে মন্ত্রী-নেতারা মুখে ফেনা তুলিতে লাগিলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়াছিল যে, বণিক সমিতির নেতা বলিলেন, এত কথা বলিলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ জঙ্গিতে ভরা এই রূপ একটি ইমেজ দাঁড়াইতেছে। কয়েকজন ব্যবসায়ী বিদেশে যাইবার ভিসা পর্যন্ত পাইতেছে না। এক্ষণে হঠাৎ করিয়াই যেন জঙ্গি লইয়া কথাবার্তা তেমন শুনিতে পারিতেছি না। বরং সংবাদপত্রে এই মর্মে খবর বাহির হইয়াছে যে, এত জঙ্গি ধরিবার পর উহারা কোথায় গেল? কি করিয়া জামিন পাইল এবং জামিন পাওয়ার পর অনেকেই উধাও হইয়া গেল, এইসব লইয়া নানা প্রশড়ব। সংবাদপত্রে দেখিয়াছিলাম জামালপুরে এক সাথে কয়েকজন জঙ্গি নারী ধরা পড়িয়াছিল। বিভিনড়ব পত্রিকায় তাহাদের ছবিও আসিয়াছে। শুনিলাম মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের দু-একজন নেতা তাহাদের ছাড়াইয়া আনার ব্যবস্থা করিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরও এইরূপ ঘটিয়াছে। অর্থ ও স্বার্থের বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীসহ কুখ্যাত রাজাকারদের রক্ষা করা হইয়াছে, তাহাদিগকে সমাজে পুনর্বাসিত করা হইয়াছে। অপরদিকে শহীদ তাজুলের মতো, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পাটি-ছাত্র ইউনিয়নের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই জীবনরক্ষার জন্য বনে-বাদাড়ে ঘুরিতে হইয়াছে।

কেহ কেহ জীবনও দিয়াছেন। অনেক ক্ষেত্রে নিরীহ লোকজনকে আটক করিয়া টাকা আদায় করা হইয়াছে। এইসবের পরিণতিতেই পাকিস্তানপন্থী, যুদ্ধাপরাধী রাজাকাররা ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দেশবাসী জঙ্গিদের শাস্তি চায়। জঙ্গিদের নেটওয়ার্কের মূলোৎপাটন চায়, উহাদের মদদ দানকারী এবং মতাদর্শিক নেতা জামাত প্রভৃতি দল এবং আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা চায়, যে আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি ক্রমাগতভাবে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি শক্তির উত্থান ঘটাইতেছে তাহার আমূল পরিবর্তন চায়।

তবে লক্ষ্য করার বিষয়, এখন সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের স্থলে মাওবাদীরাই যেন দেশের সামনে প্রধান বিপদ হিসাবে দেখা দিয়াছে। আরও লক্ষ্য করিবার বিষয়, ভারতেও এখন জঙ্গিদের চাইতে ‘মাওবাদীরাই’ বড় বিপদ হিসাবে দেখা দিয়াছে। বাংলাদেশে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর ৯ মাসে ১০০ ব্যাক্তিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হইয়াছে (জনকণ্ঠ ০৭-১০-০৯)। ইহাদের মধ্যে কেহ সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠির সদস্য বলিয়া কোনো অভিযোগ আসে নাই। ইহাদের একটি বিরাট অংশ চরমপন্থী মাওবাদী বলিয়া খ্যাত। ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধের অর্থ কি বাংলাদেশের মানুষ তাহা এতদিনে ভাল করিয়াই বুঝিতে পারিয়াছে। ভারতে একই কাজের নাম ‘এনকাউন্টার। বিচার বহির্ভূত এইসব হত্যাকান্ড বহুকাল ধরিয়া চলিতেছে। ক্রসফায়ার ধারাবাহিকভাবে শুরু হইয়াছিল খালেদা জিয়ার আমলে। অপারেশন ক্লিন হার্ট এর নামে কত মানুষকে যে হত্যা করা হইয়াছে তাহা ইয়ত্তা নাই। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইজারাদারদের কারসাজিতে ওয়ান ইলেভেনের গণতান্ত্রিক ও সুশীল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও ক্রসফায়ার সমানে চলিয়াছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সুশীলসমাজ একটি সুশীল ও আদর্শ রাজনীতি উপহার দিতে আদাজল খাইয়া রাস্তায় নামিয়া অভিনব এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় আসিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছিল। সেই সুশীল সমাজ ক্রসফায়ার, গুম, দৈহিক নির্যাতন, হয়রানি ইত্যাদি সম্পর্কে টু শব্দও করে নাই।

এক্ষণে শেখ হাসিনার আমলেও ক্রসফায়ার সমানে চলিতেছে। বিডিআর সদস্যরা একের পর এক আত্মহত্যা করিতেছে অথবা হঠাৎ করিয়াই গুরুতর অসুস্থ হইবার পর হাসপাতালে নীত হইয়া মৃত বলিয়া ঘোষিত হইতেছে। এক মন্ত্রী বলিতেছে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড চলিতে দেওয়া হইবে না। আর একজন বলিতেছে, অপরাধ দমনের জন্য ক্রসফায়ার ছাড়া উপায় নাই। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ইইউ প্রতিনিধিদের সামনে বলিয়াছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডে দোষী সাব্যস্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। অথচ এই সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করিবেন বলিয়া ঘোষণা দিয়াছিল। এক্ষণে বলিতেছে, দোষী সাব্যস্ত হইলে...। ১০০টি হত্যাকা- ঘটিল। কয়টির ব্যাপারে তদন্ত হইয়াছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হইয়াছে অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে? ক্ষমতার বাহিরে থাকিয়া অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে বহু নেতা ও দল ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে বলেন আবার ক্ষমতায় গিয়া তাহারাই নিপীড়নকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের সাফাই গাহিতে দ্বিধা করেন না। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। কোনো সরকারের আমলেই জঙ্গিরা ক্রসফায়ারে নিহত হয় নাই। কিন্তু সব আমলেই মাওবাদী চরমপন্থী বলিয়া অভিযুক্তরা ক্রসফায়ারের স্বীকার হইয়াছে। অনেক বড় বড় জঙ্গি বরং একাধিকবার গ্রেফতার হইয়াছে এবং আবার জামিনও পাইয়াছে।

দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে যেমন চরম ও উগ্রপন্থা আছে অনুরূপ বামপন্থী রাজনীতিতেও আছে চরম পন্থা। আমাদের দেশে ৬০-এর দশকে মাওবাদের উদ্ভব। সশস্ত্র সংগ্রাম, বুর্জোয়া ও শোষকদের দৈহিকভাবে নির্মূল করা, গলাকাটা, গ্রাম দখল ও গ্রাম হইতে শহর ঘেরাও, নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ নানা ধরনের তত্ত্ব ও প্রয়োগ আমরা দেখিয়াছি। অতীতে তাত্ত্বিক ভ্রান্তি এবং অন্ধ ভারত বিরোধিতা তাহাদের কোনো কোনো দল বা গ্র“পকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও পাক হানাদারদের পক্ষে দাঁড় করাইয়াছিল, তাহাও আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ঐ সব দলে অসংখ্য ভাঙ্গাগড়া, খুন পাল্টা খুনের কথা আমরা জানি। ইহাও সবারই জানা, বড় দলগুলো তাহাদের দাপট বৃদ্ধি করিতে এবং ক্ষমতায় যাইতে বা ক্ষমতা রক্ষা করিতে এইসব সশস্ত্র
গ্র“পগুলিকে ব্যবহার করিতে কুণ্ঠাবোধ করে নাই। এই সকল কাজের মধ্য দিয়া ওই সব সশস্ত্র লোকজন নানাভাবে প্রশাসন, পুলিশ ইত্যাদির সহিত নানাভাবে যুক্ত হইয়া পড়ে। অনেকে ক্রমে রাজনীতি বিবর্জিত চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের সহিত যুক্ত হইয়া পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেল মাওবাদীদের মধ্যে যাহারা অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিক বলিয়া পরিচিত তেমনি কিছু নেতৃবৃন্দকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে বিশিষ্ট নেতা হিসেবে মোফাখ্খর চৌধুরী এবং ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের নাম উলে-খ করা যায়। উহারা অনেকেই দেশে রাজনৈতিক বিশেষত বামপন্থীদের নিকট যথেষ্ট সম্মানিত। কেহ কেহ আছেন যাহাদের মার্কসবাদে হাতেখড়ি তাহাদের মাধ্যমে। কুষ্টিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কিছু ব্যক্তি নিহত হইয়াছেন, যাহাদের গণবাহিনীর সদস্য বলিয়া চিহ্নিত করা হইয়াছে। বঙ্গবন্ধুর সময় জাসদের নেতৃত্বে সশস্ত্র গণবাহিনী গড়িয়া উঠিয়াছিল। অবশ্য মহাজোটের জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও বলিয়াছেন, তাহার বা জাসদের কোনো বাহিনী নাই। আর থাকিবেই বা কেন! বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরোধিতা করিলেও জাসদ বর্তমানে শেখ হাসিনার বাস্তবে সরকারের সহিতই আছে। যাহা হউক, দক্ষিণপন্থী সরকারগুলি দক্ষিণপন্থী জঙ্গিদের চাইতে
বামপন্থী মাওবাদীদের ব্যাপারে বেশি কঠোর বলিয়া মনে হইতেছে।

নেপালে মাওবাদীদের উত্থান আসলে সমগ্র উপমহাদেশে শাসকশ্রেণী মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়াছিল। মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ড নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয়ের পর নেপালের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। আশেপাশের বুর্জোয়া রাষ্ট্রে ইহা লইয়া নানান উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। প্রচন্ডকে নানাভাবে বশ করিবার চেষ্টা ব্যর্থ হইলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রচন্ড ক্ষমতায় আসিয়া অন্যান্য প্রায় সকল দলের সহিত মিলিয়া নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হইতে সেক্যুলার রাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্র হইতে গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। পূর্বের চুক্তি অনুসারে মাওবাদী বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করিবার পরিবর্তে নতুন রিক্রুটমেন্ট শুরু করায় বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে সেক্যুলারিজম এবং রাজতন্ত্রের অবসানের বিরোধিতা করিয়া ওই সকল বিষয়ে গণভোট দাবি করেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ড সেনা প্রধানকে বরখাস্ত করেন। রাষ্ট্রপতি সেনাপ্রধানের পক্ষ নেন। প্রতিবাদে প্রচন্ড পদত্যাগ করিয়া গণআন্দোলনের পথ গ্রহণ করেন। নতুন সরকার এখনো সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভাও গঠন করিতে পারে নাই। নির্বাসিত রাজা এবং অন্যান্য রাজনীতিকরা ঘন ঘন ভারত সফর করিতেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলিয়া খ্যাত ভারত রাজা ও সেনাপ্রধানকেই সমর্থন করিতেছেন। নির্বাচিত সরকার প্রয়োজনে থাকিবে না কিন্তু মাওবাদীরা যেন ক্ষমতায় ফিরিয়া আসিতে না পারে। মাওবাদীদের ব্যাপারে উদ্বিগড়ব হইবার আরো একটি কারণ হইতেছেÑ কম্পোজা বা CCOMPSA বা Co-ordination Committee of Maoist Parties and Organization of South Asia. বিপj¡x আন্তর্জাতিক আন্দোলন বা Revolutionery International Movement (RIM) বিশ্বব্যাপী সংশোধনবাদ, সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী দল ও শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহারই ফলশ্র“তিতেব‘কম্পোজা গঠিত হয়। নেপালের মাওবাদী দলসহ ভারত, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের কয়েকটি দল ও গ্র“প লইয়া ‘কম্পোজা গঠিত হয়। উহাদের দলিল অনুযায়ী বাংলাদেশের চারটি দল উহার অন্তর্ভুক্ত। নেপাল হইতে শুরু করিয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অন্ধ্র, নাগাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্য হইয়া, বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চলকে মাওবাদীরা ‘দীর্ঘমেয়াদি জনযুদ্ধের’ জন্য উপযুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করিয়া উহার নাম দিয়াছে ‘কমপ্যাক্ট রিভিউলিশনারি জোন, Compact Revolutionery Zone (CRZ).

এই প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার এখন মাওবাদীদের দেশের নিরাপত্তার জন্য সব চাইতে বড় হুমকি বলিয়া মনে করিতেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, দেশে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টিতে মাওবাদীরা কমবেশি তৎপর। অপর এক সংবাদে প্রকাশ, দেশের ৬০২টি জেলার মধ্যে ১৬০টিতে মাওবাদীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় পার্লামেন্টকে জানানো হইয়াল্লে যে, এই বৎসরের প্রথমার্ধেই প্রায় ৪৫৫ জনকে মাওবাদীরা হত্যা করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। শুধুমাত্র ছশিগড়েই মারা গিয়াছে ১৪৮ জন। মাওবাদীরা দাবি করিতেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের ১১০০টি গ্রাম তাহাদের সহিত আছে, ৩৯০ বর্গ কি.মি এলাকা তাহাদের নিয়ন্ত্রণে। লালগড় এই রাজ্যে প্রথম ও প্রধান গেরিলা অঞ্চল। ঝাড়খন্ড এলাকায় মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ বিপজ্জনক পর্যায়ে। ভারতের পশ্চাৎপদ ও দারিদ্র্যপীড়িত ও বঞ্চিত এলাকাগুলিতে মাওবাদীদের শক্তিশালী ভিত্তি গড়িয়া উঠিতেছে। উহাদের হাতে পুলিশ বা আধা-সামরিক বাহিনীর চাইতেও আধুনিক অস্ত্র রহিয়াছে। জীবন আশঙ্কায় পুলিশ এইসব এলাকায় অপারেশনে যাইতে নারাজ হওয়ার কারণে অনেককে চাকুরি হইতে বরখাস্ত করা হইয়াছে। ভারত সরকার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করিতেছে। মজার ব্যাপার হইতেছে, ভারতের বুর্জোয়া দলগুলিও নানা সময় মাওবাদী গ্র“পকে তাহাদের স্বার্থে ব্যবহার করিতেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সহিতও নির্বাচনের সময় একটি গোপন সমঝোতা হইয়াছিল বলিয়া শুনা যায়। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, পশ্চিমবঙ্গে তাহাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু মনে হইতেছে সিপিআই ও সিপিএম। কমিউনিস্টদের হত্যা করিতে, পার্টি অফিস ভাংচুর করিতে এবং কাস্তে-হাতুড়ি খচিত লাল পতাকা পুড়াইয়া ফেলিতে তাহারা দ্বিধা করে না। লালগড় ও অন্যান্য জায়গায় সিপিএম ও সিপিআই-এর নেতা-কর্মীদের ঘর হইতে বাহির করিয়া হত্যা করা হইয়াছে। তাহারাই মনে হয় মাওবাদীদের প্রধান শ্রেণীশত্র“। অথচ ভারতে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর মাওবাদীরা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্টে বলিয়াছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের পুনর্বিজয়ের এই যে ঘটনা ও কংগ্রেসের আসন বৃদ্ধি এবং আগের বারের স্বল্প সময়ের তুলনায় এইবার তাহাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা ইউপিএ ও কংগ্রেসকে আরও নিষ্ঠুর বৃহত্তর মিলিটারি আক্রমণ নামাইতে সুবিধা করিয়া দিবেÑ (যা আসিয়া পড়িবে) আমাদের দল ও আন্দোলনের উপর। আগের সরকারে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কম থাকায় তাহাদিগকে অনেক মিত্রশক্তির উপর নির্ভর করিতে হইয়াছিল। যাহাতে তাহাদের ক্ষমতা বজায় থাকে। এবং বামপন্থীরা প্রায় চার বছর ধরিয়া মনমোহন সিং সরকারকে যথেষ্ট চাপে রাখিয়াছিল।

আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই সকল ইউপিএ সরকারকে আরো বিভৎস আইন এবং ‘ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিকে কাজে পরিণত করা এবং গণআন্দোলনকে শ্বাসরোধের সাহায্য করিয়াছে।”

বস্তুত, গত ইউপিএ সরকারে বামপন্থীদের অবস্থানের কারণেই নেপালে মাওবাদীদের বিজয়ের পর ভারত হস্তক্ষেপ করিতে পারে নাই। ভারতের মাওবাদীরা তাহাদের উপর ‘ফ্যাসিস্ট নির্যাতন ডাকিয়া আনিতেই যেন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে আদাজল খাইয়া নামিয়াছে। উহারা লালগড়, নন্দীগ্রাম সহ বিভিনড়ব স্থানে কি ভাবে তৃণমূল কংগ্রের সহিত ঐক্য করিলেন। কি ভাবে নির্বাচনে তাহারা অনেক ক্ষেত্রেই বামফ্রন্টের প্রার্থীদের পরাজিত করিতে সহযোগিতা করিলেন। বামফ্রন্টকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হইতে হঁটাইতে পারিলেই কি মাওবাদীদের বিপনড়ব হইয়া যাইবে? নাকি ‘ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের শক্তিরাই ক্ষমতায় যাইবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই অতীতে নকশালপন্থীদেরকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করিবার বিরোধিতা করিয়াছে। সম্প্রতি মাওবাদীদের নিষিদ্ধ করারও বিরোধিতা করিয়াছেন। সিপিআই সাধারণ সম্পাদক এবি বর্ধন বলেন, ... বিষয়টিকে মোটেই আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা উচিত নহে।

মাওবাদী সমস্যার সামাজিক-অর্থনৈতিক মাত্রা আছে। ইহা প্রধানত প্রত্যন্ত, পশ্চাৎপদ, উপেক্ষিত অঞ্চল এবং যেখানে সামন্ত ও আধা-সামন্ত চরম ও বল্গাহীন শোষণ বর্তমান, প্রধানত সেইসব ক্ষেত্রেই মাওবাদীরা তাহাদের কার্যকলাপের এবং নিজের প্রভাব বিস্তারের উপযুক্ত স্থান হিসাবে খুঁজিয়া পায়।... মূলত, যে সকল অঞ্চল দশকের পর দশক ধরিয়া প্রশাসনের অবহেলায় পশ্চাৎপদ হইয়া পড়িয়া আছে, সেই সব অঞ্চলেই মাওবাদীদের গতিবিধি...।” (এবি বর্ধন, শারদীয় কালান্তর ১৪১৬)

ভারতের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি, নেপালে মাওবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ভারতে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকতর অভিযান এবং বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে চরমপন্থীদের হত্যাকান্ডের মধ্যে কোথায় যেন একটি যোগসূত্র দেখিতে পাওয়া যায়।সাম্প্রতিককালে ভারত-চীন-নেপাল-বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্তে উত্তেজনা এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদির সাথেও কোথায় যেন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানের একটি সম্পর্ক আছে বলিয়া মনে হয়।

No comments: