Pages

Wednesday 27 July 2011

কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কাছে ইতিহাসের দাবি

কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কাছে ইতিহাসের দাবি
মনজুরুল আহসান খান

বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। স্বাধীনতার চলি-শ বছরের মাথায় আওয়ামী মহাজোট মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের শত বছরের সংগ্রামের ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা বিধৃত হয়েছিল ‘৭২-এর সংবিধানের ঘোষিত মূলনীতিতে, তাকে আজ বিকৃত করে স্থায়ী করা হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী লুণ্ঠন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী গণ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সব মহান আদর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম তা আজ ভূলুণ্ঠিত। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শের প্রশ্নে শুধু পশ্চাদপসরণ করেন নাই, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পতাকা গুটিয়ে নিয়ে জিয়ার রহমান ও এরশাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপরও নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন।

অপরদিকে জনজীবনে আজ নাভিশ্বাস। বেকারত্ব, দারিদ্র ধন-বৈষম্য ও দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া সাধারণ মানুষের জীবন এলোমেলো করে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের সঙ্কট বেড়ে চলেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, টেন্ডার-বাজী, চাঁদাবাজি, দলবাজি চরমে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, যৌন নির্যাতন, দমন-পীড়ন, ক্রসফায়ার, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা জননিরাপত্তা ও শান্তি মারাত্মকভাবে ব্যাহত। অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন সর্বক্ষেত্রে নীতি পদক্ষেপগুলি করছে মুষ্টিমেয় ধনিকদের স্বার্থে। ভিআইপি ও প্রাইভেট কারওয়ালাদের জন্য রাজধানী ঢাকাÑ এই চিন্তা থেকে এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী, একের পর এক রাস্তায় রিক্সা চলাচল নিষিদ্ধ করে সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত, বৃদ্ধ, নারী শিশুদের চলাচল অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে। জ্বালানী সঙ্কটে বিপর্যস্ত শিল্প। সারের মূল্য বৃদ্ধিতে, ভেজালে কৃষক দিশেহারা, শ্রমিক বাঁচার মতো মজুরী থেকে বঞ্চিত, জুলুম অত্যাচারের শিকার।

সমুদ্র বক্ষে মার্কিন কোম্পানির সাথে রফতানিমুখী জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিকে তোয়াজ তোষামোদ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা গোপন ও প্রকাশ্য চুক্তিতে বাংলাদেশকে বেধে ফেলা হয়েছে।

অপরদিকে বিএনপি জামাত জোট পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। সাম্প্রদায়িক, উগ্রধর্মান্ধ শক্তি এবং স্বাধীনতা বিরোধীরা সবাই একত্রিত হয়ে দেশে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল মহল দেখছে আওয়ামী ও বিএনপি জোটের দুর্নীতি লুটপাট ও অপশাসন দেশে গণবিদ্রোহের পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নিজস্ব বিকল্প আছে। আমরা তা দেখেছি এক-এগারোর ঘটনায়। দেশের তথাকথিত কিছু সুশীল সমাজ, বিভিন্ন দলের কিছু লোকজন, সামরিক, বেসামরিক আমলাদের মধ্যে কিছু এবং এনজিওর কিছু কর্মকর্তাদের নিয়ে ওরা এক এগারো ঘটিয়ে ছিল। এক পর্যায়ে ওরা পিছিয়ে গেলে বা আপোষ করলেও তারা এক-এগারোর এজেন্ডা বাতিল করেনি। এখনকার অচলাবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আবারও আরও জোরেশোরে এক-এগারো ঘটাবার চেষ্টা চলছে।

কি হবে দেশের? আমরা চলি-শ বছর ধরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দেখেছি। দেখেছি সামরিক শাসন এবং এক-এগারো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশের ও জনগণের সমস্যা-সঙ্কট কমেনি বরং আরও জটিল হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ এখন এমন পর্যায়ে যে, যেকোনো কিছু ঘটলেই মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কি? আওয়ামী জোটের কাছে পাওয়ার কিছু নেই। একদা আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি মহাজোটে যোগ দিয়ে দলটিকে পথে আনতে পারে নাই। বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিজে বিএনপির রাজনীতির আরও কাছাকাছি গিয়েছে।


বিএনপি এখন জামাতের রাজনীতির খপ্পরে। তারা তো আরও পিছিয়ে নিতে চায় দেশটাকে। আওয়ামী লীগ যতটা পিছিয়েছে তাতেও তারা সন্তুষ্ট নয়। ওরা ক্ষমতায় এলে আরও সর্বনাশ হবে।

সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশী প্রভুরা যে তৃতীয় বিকল্প নিয়ে আসতে চায়, তা কি ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে দেশবাসীর সেই অভিজ্ঞতা আছে। ইতিহাসের দাবি আজ একটি বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প। বস্তুত: মুক্তিযুদ্ধের সময়ই এই বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তা আরও জরুরী হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের সেই দাবি পূরণ করতে না পারায় চলি-শ বছর ধরে দেশ সঙ্কটের আবর্তে খাবি খাচ্ছে।

এক পর্যায়ে দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বাইরে একটি বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে ওঠে। বৃহত্তর পর্যায়ে ১১ দলও গঠিত হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশবাসীর কাছে দেয়া ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বেশির ভাগ দলই একটি মেরুর সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সিপিবি একা রয়ে যায়। কিন্তু সিপিবি তার ঘোষিত বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার ঘোষণা থেকে মুখ ফেরায়নি। কবি দিলওয়ারের ভাষায় কমিউনিস্টরা হিম্মত দেখিয়েছে, জনগণের বিশ্বাস হারায় নি। একা বা মাঝে মাঝে সঙ্গে যাদের পাওয়া যায় তাদের নিয়েই লড়ে যাচ্ছে।

‘৭২-এর সংবিধানের মূল নীতি পুনঃ-প্রতিষ্ঠার পক্ষে সিপিবি আগাগোড়া বলেছে। দৃঢ়ভাবে লড়েছে। আওয়ামী লীগ বলেনি। অন্যান্য দুচারটি বাম দলও বলেছে। তারা এবারে সংবিধানের সংশোধনীর বিরুদ্ধে বললেও শেষ পর্যন্ত পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। অনেকগুলো সংগঠনই ’৭২-এর সংবিধান নিয়ে সোচ্চার ছিল। এখন তাদের কণ্ঠ যেন ক্রমেই ম্রিয়মাণ। সংবিধান বিকৃতির বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখলে তারা বিচলিত হন। সিপিবি লড়ে যাচ্ছে। বাসদও এগিয়ে এসেছে। নানা সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী, তরুণরা এগিয়ে আসছে।

বামের মধ্যে অনেকেই আছেন তারা যত ছোট, আওয়াজ ও প্রচারণা তত বড়। অনেকেই কথায় বড় হয়ে আছে। অনেকেই তীব্র শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন কিন্তু আসল লড়াইয়ে তাদেরকে মাঠে-ময়দানে পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে দুএকজন
এমনও আছেন যারা ‘৭১-এ দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে মনেই করেন না। ‘৭২-এর সংবিধান আওয়ামী লীগের বকশিস নয়।
মুক্তিযুদ্ধটাও আওয়ামী যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের শতবর্ষের সংগ্রামের পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ‘৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে লড়েছে, জীবন দিয়েছে এদেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। বামপন্থীদের কিছু ত্রুটি দুর্বলতার জন্য আওয়ামী লীগ এক সময় আন্দোলনের পুরোভাগে চলে আসে। আজ আওয়ামী লীগ ‘৭২-এর সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের পতাকা গুটিয়ে নিচ্ছে। কমিউনিস্টরা কি বলবেÑ ওসব বুর্জোয়াদের ব্যাপার! ওসব নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই? না। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়। বাংলাদেশটাও নয়। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল সমস্ত বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম। কমিউনিস্টরা এই সংগ্রামের স্থপতি। কমিউনিস্টরা রক্ত দিয়েছে এই সংগ্রামে। আমরা ছাড়বো না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবো। আমরা আমাদের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। জনজীবনের সঙ্কট মোচনের জন্য সর্ব ক্ষেত্রে গণমুখী নীতির জন্য ব্যাপক গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে আমাদের। এই গণসংগ্রাম গড়ে তুলতেই বর্তমান অবস্থায় সিপিবি ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলনের আহবান জানিয়েছে।

দেশে তেল-গ্যাস আন্দোলন, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, ছাত্র, যুব, নারীসহ সব গণআন্দোলনেই আমরা আছি। কিন্তু সামগ্রিক দাবি নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সেই আন্দোলনেই এগিয়ে যাচ্ছে কমিউনিস্টরা। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পার্টির শক্তি বৃদ্ধি হবে। প্রয়োজনে ১১ দফা পরিবর্তন পরিবর্ধনের মধ্যদিয়ে অন্যান্য বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হবে। যুক্ত হবে অসংখ্য ব্যাক্তি, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। কিছু দল ও ব্যাক্তি আসতে শুরু করেছে। এই লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়েই গড়ে তুলতে হবে জনগণের আস্থাভাজন একটি বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি।



লড়াই লড়াই লড়াই চাই,
লড়াই ছাড়া মুক্তি নাই।
ভীরু যারা তারা দূরে থাক,
অবিশ্বাসী দূরে যাক।
মরদ যারা তারা আয়
এই হাতে হাতিয়ার নিয়ে আয়
খুন দিয়ে দুনিয়াটা জয় করে নে,
ওরে নিঃস্ব নিঃসম্বল। (সত্যেন সেন)


লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশর কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি

No comments: